লাইট বাল্বের আবিস্কারকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম সেরা আবিস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ছোটকাল থেকে আমরা এটা জেনেই বড় হয়েছি যে লাইট বাল্বের আবিস্কারক থমাস আলভা এডিসন। কিন্তু আসলেই কি তাই? (এই লেখায় লাইট বাল্ব এবং বৈদ্যুতিক বাতি একই অর্থে ব্যবহার করা হবে না। এই লেখার মূল ফোকাস ‘বাতি’, সেটা যেই ফরম্যাটেই হোক না কেন।)
প্রশ্ন হচ্ছে এই বাতি আবিস্কারক হিসেবে আলভা এডিসনই কি একমাত্র পাইয়োনিয়ার?
প্রশ্নটা একটু জটিল। তবে আলভা এডিসনের কারণে বাকী সবাই যে প্রাদপ্রদীপের আলো থেকে হারিয়ে গেছেন, সেটাও একেবারে অনুচিত।
আলভা এডিসন যখন বৈদ্যুতিক বাতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, তার অনেক আগে থেকেই প্রায় একই রকম বাতির ধারণা নিয়ে কাজ হচ্ছিল, কিন্তু সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাটে। সে সময় পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী অন্তত ২০ জন গবেষক বিভিন্ন ধরণের বাতির পেটেন্ট নিয়েছিলেন।
১৮০৬ সালে ইংলিশ উদ্ভাবক হামপ্রি ড্যাভি ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটির সামনে নিজের উদ্ভাবিত বৈদ্যুতিক বাতি প্রদর্শন করেছিলেন। কিন্তু সেটি খুব দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায় এবং তিনি তার উদ্ভাবনকে আরও উন্নত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। ১৮৪১ সালে আরেক ব্রিটিশ উদ্ভাবক ফ্রেডেরিক ডিমলিন্স প্রায় একই রকম আরেকটি বাতির ধারণা সামনে আনেন। ১৮৪৫ সালে আমেরিকান জে.ডব্লিউ স্টারও তার উদ্ভাবিত বাতির পেটেন্ট নেন।
ইংলিশ রসায়নবিদ জোসেফ শন বার্নার এবং বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল দিয়ে একটি বাতি তৈরী করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেটি কার্যকর হয়নি। আলভা এডিসন যেটি করেছেন, সেটি হচ্ছে সে সময় পর্যন্ত বাতির যেসব ধারণা ছিল, সেগুলোকে আরও মোডিফাই এবং উন্নত করেছেন, সেগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তখনকার বাতির ধারণাগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এসব আইডিয়াকে ভিত্তি ধরেই আরও উন্নত বাতি আবিস্কার করা সম্ভব এবং তিনি একদল গবেষক নিয়ে মনেপ্রাণে সেই কাজটিই করেছেন এবং সফল হয়েছেন।
আলভা এডিসন যখন বাতি নিয়ে আরও বিস্তর গবেষণায় নামেন, তখন আগের বাতিগুলোর সীমিত কার্যকারিতা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে বাতির আরও কিছু কম্পোনেন্ট আবিস্কার করেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি ফিলামেন্ট আবিস্কার করেন, যেটি উচ্চ তাপমাত্রায়ও নষ্ট হয় না। এই ফিলামেন্ট ছিল বৈদ্যুতিক বাতিকে কার্যকরী করার লক্ষ্যে সবচেয়ে বড় আবিস্কার। তবে তার সবচেয়ে বড় সফলতা শুধু বাতির নতুন কম্পোনেন্ট আবিস্কার বা কার্যকারিতা বাড়ানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি বিভিন্ন কোম্পানিকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে এ বাতিই পরবর্তী বিশ্বের ভবিষ্যত এবং এটি একটি যুগান্তকারী, পৃথিবী বদলে দেওয়া আবিস্কার। কোম্পানিগুলো তার কথায় কনভিন্স হয়ে বাতিগুলোকে ব্যাপকভাবে বাজারজাত করা শুরু করে। অর্থাৎ, আলভা এডিসন শুধু বৈদ্যুতিক বাতির কার্যকারিতা বাড়ানোতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, এটিকে গণমানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করার পেছনেও তার অনবদ্য ভূমিকা ছিল। বিভিন্ন কম দামি ম্যাটেরিয়াল দিয়েও কীভাবে টেকসই বৈদ্যুতিক বাতি তৈরী সম্ভব, সেটিও দেখিয়েছেন এডিসন, এর ফলে বাতির দাম অনেক কমে গেছে এবং ফলশ্রুতিতে এর জনপ্রিয়তাও বেড়েছে অনেক।
মোটকথা, আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি আবিস্কার না করলেও তিনি এটিকে আরও পারফেক্ট করতে এবং বৃহত্তর এলাকাতে বাতি স্থাপন করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কিন্তু তারপরও কেন এর আবিস্কারক হিসেবে এককভাবে শুধু আলভা এডিসনের নামই সারা বিশ্বে আলোচিত হয়?
এর উত্তর পাওয়া যাবে এডিসনের ব্যাক্তিজীবনের দিকে তাকালে। ব্যাক্তিজীবনে এডিসন খুবই মিশুক এবং প্রেজেন্টেবল একজন মানুষ ছিলেন। তিনি তার উদ্ভাবনকে জনসম্মুখে খুব ভালো করে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, এবং এ কাজে তাকে বিস্তর সাহায্য করেছেন তার ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক বন্ধুরা। সাংবাদিকেরা এডিসনক এবং এ বাতি নিয়ে তখন এমনভাবে লেখালেখি করেছেন যে ধীরে ধীরে এই অসাধারণ আবিস্কারের পেছনে অন্যদের অবদান ঢাকা পড়ে গেছে!